চেম্বার থেকে বের হওয়া মাত্রই হাত থেকে ব্যবস্থাপত্র কেড়ে নেন দালালরা। ব্যবস্থাপত্র দেখে দালালরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম বলে দেন। তাদের ক্লিনিকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন এই পরীক্ষাটা শুধু সেখানেই করা হয়। এমনটিও বলে দেন রোগীদের। এভাবেই প্রতিনিয়ত মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগ ও জরুরী বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীরা হয়রানির শিকার হন। এমন অভিযোগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা প্রায় সকল রোগীর।
হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরী বিভাগে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য। অন্তঃবিভাগে দালালদের পদচারণা এই দুই চক্রের কাছে জিম্মি রোগীরা। এছাড়াও হাসপাতালে প্রয়োজনীয় লোকবল, চিকিৎসক সংকট থাকায় চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা।এলাকার ভুক্তভোগী রোগীরা জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল সংকট সহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যার, অথচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন ১০ জনের জায়গায় মাত্র ৫ জন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদগুলোও শূন্য। রক্ত ও মলমূত্র ছাড়া অন্য কোনো পরীক্ষা হয় না। বেশিরভাগ ঔষধ বাইরে থেকে কিনতে হয় রোগীদের। এতে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীদের।
সিরাজদিখান উপজেলার ১৪ টি ইউনিয়ন সহ পার্শ্ববর্তী দুইটি উপজেলার বেশ কিছু গ্রামের প্রান্তিক এলাকার প্রায় ৩ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসা এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তিন লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবা দিতে নেই প্রয়োজনীয় লোকবল, চিকিৎসক সংকট ও যন্ত্রপাতির অভাবসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৮ সালে ছোট একটি অন্থায়ী ভবনে এ হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে বর্তমান ভবনটিতে ৩১ শয্যার সেবা কার্যক্রম চালু হয়। ২০০৭ সালে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। জনবল সংকটের কারণে হাসপাতালে শুধু রক্ত ও মলমূত্র পরীক্ষা করা যায়। অন্য সব পরীক্ষাগুলো বাইরের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করতে হচ্ছে। হাসপাতালে দুটি ডিজিটাল এক্সরে মেশিন থাকলেও পুরনোটি নষ্ট এক বছর ধরে। একটি ভালো থাকলেও নেই এমটি রেডিওলজি। হাসপাতালে ইসিজি মেশিন থাকলেও অপারেটর না থাকায় জরুরি বিভাগের রোগীদের পার্শ্ববর্তী ক্লিনিক- ডায়াগনস্টিক থেকে ইসিজি মেশিন এন এ পরীক্ষা করা হয়। আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন রয়েছে নেই অপারেটর।
হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রোগীদের রয়েছে বহু অভিযোগ। সুকৌশলে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নেয়া সহ চালকের বিরুদ্ধে রয়েছে রোগীর স্বজনদের নানান অভিযোগ। তিন লাখ মানুষের জন্য একটিমাত্র এম্বুলেন্স তাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে বাড়তি ভাড়া দিয়ে রেন্ট-এ-কারের গাড়িতে ঢাকায় নিতে হয় রোগীদের। রেন্ট-এ-কারের গাড়ির চাহিদা থাকায় রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ীরা হাসপাতাল কম্পাউন্ডে গড়ে তুলেছেন অবৈধ পার্কিং ব্যবস্থা। চিকিৎসা নিতে আসা সোহরাব শেখ ( ৮০) বলেন, বাইরে থেকে একটি এক্সরে করে এনেছি ডাক্তার দেখাবো ক’দিন ধরে রিপোর্ট নিয়ে ঘুরে যাচ্ছি অর্থপেডিক ডাক্তারের দেখা পাচ্ছিনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রোগী দৈনিক সভ্যতার আলোকে বলেন, ছাড়পত্র দেয়ার পর গত ১৫ দিন বাড়ি থেকে আনা নেয়া করে ছেলেকে বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার দেখিয়ে বের হতেই ঘিরে ধরেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। তারা ছবি তুলেন। এসব কাজে রোগীর কষ্ট বাড়ে। আমাদেরও ভোগান্তি হয়।
বাংলাদেশ মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ অ্যাসোসিয়েশন (ফারিয়া) সিরাজদিখান উপজেলা শাখার সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতিটি ওষুধ কোম্পানি তাদের প্রতিনিধিদের মাসিক বিক্রির টার্গেট দেয়। যদি তা না করতে পারে, তাহলে বেতন কমে যায়। কখনও চাকরিও চলে যায়। যার কারণে ডাক্তারদের কাছে বারবার যেতে হয়। কথা বলতে হয়। যেহেতু মার্কেটে নতুন নতুন প্রোডাক্ট আসছে, তাই ডাক্তারদের নিকট সে বার্তা পৌঁছানোর জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি আরো জানান, প্রতিনিধিদের ফারিয়ার পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। জরুরী বিভাগে বেলা ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত। সপ্তাহের বুধবার ও শনিবার বেলা সাড়ে ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত বহিঃ বিভাগে। তারপরও কিছু প্রতিনিধি নিয়ম ভঙ্গ করে কাজ করে কোম্পানির টার্গেট পূরণ করার জন্য। আর ছবি তোলার বিষয়টি হলো, কোম্পানির ওষুধ ডাক্তার লিখছে কি-না, তা কোম্পানির নিকট প্রমাণ হিসেবে ছবি দিতে হয়। আমরা আরো কঠোর হচ্ছি। এরপর নিয়ম ভঙ্গ করলে আমরা কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আঞ্জুমান আরা সভ্যতার আলোকে বলেন, রোগীদের ভালো সেবা দেয়ার জন্য আমি সার্বক্ষণিক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকি। কিন্তু এক্সরে মেশিন নষ্ট বিভিন্ন কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এসব সমস্যা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে আশা করি শীঘ্রই ভালো কোন ফলাফল পাব। অন্যসব বিষয়গুলোর ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলে সঠিক তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Leave a Reply