ছাত্র জীবন থেকেই ছবি দেখার নেশা। এমন নেশা যে প্রতি সপ্তাহে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি দেখতেই হবে। না দেখতে পারলে পাগল প্রায় হয়ে যেতাম। কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, লাকসাম, মাইজদি এমন কি চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে ছবি দেখতেই হতো। ছবির কাহিনীর সাথে হলে বসে কান্না-হাসি আমিও করতাম। পাশের বন্ধু বলতো কি তোর কান্দন আইলো ক্যা। এডা তো সত্য নয়। সত্য-মিথ্যা যাই হোক আবেগে বেগের সাথে চরিত্রের সাথে মিশে যেতাম। এভাবে কখন যে প্রিয় নায়িকা কবরীর সাথে কল্পনায় মিশে গেছি। তা কিশোর মনে বলতে পারিনি তখন। বিশেষ করে কবরীকে দেখার জন্য ছবি দেখার মাত্রা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন বড় দুলাভাই রেলওয়ের কর্মকর্তা আর ছোট দুলাভাই ঢাকা বিদ্যুতের কর্মকর্তা ছিলেন। থাকতাম শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনী। মাঝে মধ্যে পত্রিকা অফিসে যাই। আড্ডা-সাড্ডা দেই। চিত্রালী-পূর্বাণী ও চোখেচোখে পড়তাম। পাতায় কবরীর ছবি দেখি এবং পত্রিকা ক্রয় করি। মনে মনে ভাবি কিভাবে স্বপ্নের নায়িকার সাথে দেখা করা যায়। এফডিসির গেইটে প্রায় যেতাম। আর বিভিন্ন সিনেমা হলে ছবি দেখতাম।
ঘুরছি তো ঘুরছি। এরই মধ্যে কয়েকজন বন্ধু পেলাম। কবরীর কথা বললাম। বুঝতে পারছিলাম না কেমন করে কবরীর কাছে যাবো। একদিন এক সাংবাদিক বললো এটা কোন ব্যাপার না। সাংবাদিক হও দেখা পাইবা। বুদ্ধিটা মনে ধরলো। কয়েকদিন বিভিন্ন পত্রিকায় অফিসে গেলাম। একদিন ফরিকরাপুলস্থ (বর্তমানে জি-নেট টাওয়ার) তৃতীয় তলায় তারকা বাণী পত্রিকা অফিসে যাই। গিয়ে পরিচয় হই নিউজ এডিটর মাঈনুল হক ভ‚ঁইয়া, বিশেষ প্রতিনিধি দেবাশীষ সান্যাল এর সাথে। তারকা বাণীর সম্পাদক ছিলেন মরহুম ফকির আমীর হোসেন। আমি রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিলাম। সেখান থেকেই বাচসাস-এর সদস্য হলাম। কিন্তু স্বপ্নের নায়িকা কবরীর কাছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নিজেই এবার সিদ্ধান্ত নিলাম পত্রিকার সম্পাদক হবো। বাজারে চিত্রালী, পূর্বাণী, বিচিত্রার মালিকরা নিশ্চয় নায়িকাদের সাথে সম্পর্ক বা চেনা-জানা আছে। যে কথা সেই কাজ। ১৯৯৯ সালে প্রথম আনন্দ বিনোদন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে ডিক্লারেশন পাইলাম। আনন্দ বিনোদন দিয়ে সম্পাদক হিসেবে যাত্রা শুরু। এরপর বিনোদন ধারা, বিনোদন জগত, বিনোদন ভুবন, বিনোদন আলো, চাওয়া-পাওয়া, চৌদ্দগ্রাম সংবাদ, গোয়েন্দা রিপোর্ট, অপরাধ প্রতিদিন সহ ৯টি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশন হলাম। সেই সুবাদে শুধু কবরী-শাবানা নয়Ñ তৎকালীন সুপার স্টারদের সাথে আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিনোদন সাংবাদিকতায় আমার উক্ত পত্রিকাগুলো এখন ইতিহাস। মূলত স্বপ্নের নায়িকা মিষ্টি মেয়ে কবরীর সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য সাংবাদিক তথা সম্পাদক-প্রকাশক হওয়া। তার সাথে দেখা হয়েছে কথা হয়েছে। কত জানা-অজানা মনের ভাব প্রকাশ তা বলাই বাহুল্য। তবে মিষ্টি মেয়ে কবরী আমাকে প্রথম থেকেই অনেক পছন্দ করতেন এবং দেখলে হাসি দিয়ে বলতেন মজুমদার তুমি কেমন আছো। আমি কত গভীরে গিয়ে ভালোবাসি তা আকার ইঙ্গিতে বললেও তিনি হয়তো ভক্ত হিসেবে হালকা করে দেখতেন। কিন্তু আমি যে তার জন্য ঢাকায় এসে বিনোদন পত্রিকার রিপোর্টার ও সম্পাদক হয়েছি, তা বোঝানো সম্ভব হয়ে উঠেনি। মনের কথা মনেই রইলো। কারো কাছে গভীরভাবে বললে পেছনে আবার কি বলে। তবে যাই হোক সেই বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেত্রী কবরী আমার মতো অনেক অজানা সিনেমাপ্রেমীর স্বপ্নের রানী করোনায় আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। যার জন্য আমার এতো কিছু এতো আয়োজন পরোক্ষভাবে প্রতিষ্ঠিত সম্পাদক হয়েও তার সাথে শেষ দেখাটা কেন জানি হলো না। যাই হোক কিশোর মনের সেই ভালোবাসা আমার বেদনার অক্ষরে লেখা, ভাবনার সৈকতে দ্বগ্ধ করে অবিরাম। মনে পড়ে কবরীকে। তার বিখ্যাত হাসি আমার চোখে ভাসছে ভুলিতে পারিনা কোন মতে।
কবরী অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যেÑ সুতরাং, জলছবি, বাহানা, আবির্ভাব, বাঁশরী, যে আগুনে পুড়ি, দ্বীপ জেলে যাই, দর্পচ‚র্ণ, ক খ গ ঘ ঙ, ময়নামতি, সারেং বৌ, দেবদাস, সুজন সখি, হীরামতি, চোরাবালি, পারুলের সংসার উল্লেখযোগ্য ও ব্যাপক আলোচিত।
সুতরাং ছবির মধ্যে দিয়ে কবরীর চলচ্চিত্রে অভিষেক ১৯৬৪ সালে। সর্বশেষ আয়না নামে একটি ছবির পরিচালনার কাজ শুরু করেন। রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণে ছবিটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি। ২০০৮ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কবরী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার, বাচসাস পুরষ্কার সহ বহু পুরষ্কার লাভ করেন। উল্লেখ্য, আমার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ বিনোদন সাংবাদিক সমিতির বাবিসাস অ্যাওয়ার্ড তার হাতে তুলে দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আজ আমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ধারা মিডিয়ার ব্যানারে ১০টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছি। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য আমার প্রিয় নায়িকা এখন আর নেই। বাংলা সিনেমার নায়িকা কবরী ইতিহাস হয়ে থাকবেন চিরদিন, চিরকাল। যেখানে থাকুন ভালো থাকুন।
Leave a Reply